শুক্রবার। গত কয়েকদিনের তুলনায় আজকে সূর্যের তাপ একটু বেশি বেশি। তবে সেটা কারো কাছে বাঁধা হয়ে উঠতে পারেনি। জুম্মার নামাজের পর থেকেই শাহবাগের উদ্দেশ্যে ছাত্র জনতার মিছিল আসতে শুরু করেছে। বয়স, পেশার গন্ডি ভেঙে ছেলে মেয়ে সবাই যেন আজ শিকলভাঙার গান গাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। শাহবাগে আজ যে জনসমুদ্র হতে চলেছে তা একদিনের ফসল না। বছরের পর বছর ধরে মাটির প্রবাহে তা যেমন পাথরে রূপ নেয়, এই মানুষগুলোও ঠিক যেন সেই এক এক টুকরো পাথর। কেউ এসেছে ছাত্রদের হাতকে আরো শক্তিশালী করতে। কেউবা এসেছে এই জনসমুদ্রে পানি, চিপস, বানাম, চা সিগারেট বিক্রি করতে। আবার কিছু মানুষ আছে যারা শুধু ছবি তুলতেই আসে। তাও আসুক। রাজপথে এসে তারা তো অন্তত আন্তোলনে মাথা বাড়িয়েছে। তথাকথিত সুশীল শ্রেণী তো এসব টিভিতে দেখবে। আর বড় বড় কথা বলবে। সৃষ্টিকর্তা ভাগ্যিস এসব সুশীলদেরকে মুখের জবান বন্ধ করে দেয় না। তাহলে কথার অভাবে পেছন থেকে হাওয়া ছড়াতো।
দাঙ্গা পুলিশের সাথে রমনা থানার সব পুলিশ একসাথে অবস্থান নিয়েছে শাহবাগ। থানার গেট থেকে পাবলিক লাইব্রেরির গেট বরাবর তাঁরকাটা, লোহার বেরিক্যেট আর পুলিশসৃষ্ট কয়েকস্তরের বলয়। কোনো ভাবেই পুলিশ আজকে ছাত্রজনতাকে শাহবাগ দখল করতে দেবে না। কোনো ভাবেই না। উপরের নির্দেশ, অক্ষরে অক্ষরে পালন হওয়া চায়। একটু এদিক ওদিক হলেই বিপদ। সফল হলে বাহবা মিলবে। আর ব্যর্থ হলে জবাবদিহিতা। আন্দোলন দমাতে ব্যর্থ পুলিশকর্তাদেরকে উত্তরবঙ্গে বা পাহাড়ে পোস্টিং দেওয়া নতুন কিছু না। তবে ছাত্র জনতাও আজকে শাহবাগ দখল করতে মরিয়া। শুক্রবার, বন্ধের দিন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস বন্ধ। তাই জমায়েতও বাড়ছে ধীরে ধীরে। দুপক্ষ্যই তাদের সিদ্ধাতে অনঢ়। নিজেদের অবস্থান, শক্তির জানান দিতে দুপক্ষ্যকেই আজকে জিততে হবে। তবে যুদ্ধের ময়দানে সবসময় জয়ী হয় একপক্ষ্য। ছাত্র জনতার হাতে স্বৈরাচার বিরোধী প্লেকার্ড, ফেস্টুন, কারো হাতে পাতাকা, কারো মাথায় পতাকার আদলে কাপড় বাঁধা। নানা ভাবে বৈষম্যের স্বীকার এই রক্তচোখা প্রতিটা প্রাণ যেন আজকে সূর্যসেন হয়ে ফিরে আসছে শাহবাগ জয় করতে। তীতুমীর, সূর্যসেনরূপী এসব সূর্যসন্তান যারা মাথায় কাফনের কাপড় বেঁধে গায়ে বাংলাদেশের পতাকা বেঁধে রাজপথে নেমেছে, দুনিয়ার কোনো শক্তির কি আজ সাধ্য আছে তাদের থামাবার?
সময়ের জনপ্রিয় লেখক, কোটি ভক্তের আইকন সাফায়েত তার সহধর্মিণী নবনীতাকে নিয়ে এসেছেন ছাত্র জনতার এর যৌক্তিক আন্দোলনের মহাসমুদ্রে, ছাত্রদের দাবীতে তাদের সমর্থন জানাতে। দেশের এই পরিস্থিতিতে ঘরে বসে টিভিতে না দেখে ছাত্র জনতার যৌক্তিক দাবিতে তাদের সাথে রাজপথে নামাটাই প্রশান্তির। সাফায়েত বিভিন্ন প্লাটফর্মে নিজের লেখার মাধ্যমে জনমত গঠনের পাশাপাশি সস্ত্রীক আন্দোলনের মাঠেও সরব আছেন। সাফায়েতের অনেক ভক্ত আসছে তার সাথে ছবি তুলতে। সাফায়েত তাদের কে বোঝাচ্ছেন প্রয়োজনে একদিন আয়োজন করে সবার সাথে ছবি তুলতে আসবেন। এখন ছবি তোলার সময় না। তাতে মেইন ফোকাস সরে যেতে পারে। দেয়ালে পিঠ ঠেকেছে, আগে বিজয় দরকার, তারপর বিজয়োল্লাস।
এই জনসমুদ্রে টিভিনাটকের বর্তমান সময়ে জনপ্রিয় অভিনেতা দিদারকে দেখতে, ছবি তুলতে ভীড় করেছে তার অনেক ভক্ত। তবে দিদারও এড়িয়ে চলছে এই সময়ে। এখন সময় প্রতিবাদের। দেশে এত এত মানুষকে বিনা দোষে গ্রেফতার করা হচ্ছে, গুম করা হচ্ছে। আর কতকাল প্রতিবাদ না করে ঘরে বসে থাকবে? শুটিংএ দিনে লাখ টাকা পারিশ্রমিক নেওয়া দিদার শুটিং না করে খাবার পানি নিয়ে এসেছে সংহতি জানাতে।
কাশ্মিরীটোলা মোড়ের পাশে ছোটভাট মসজিদের সামনে রহমান চাচার ফার্মেসি আছে। চাচীকে নিয়ে রহমান চাচাও এসেছেন এই আন্দোলনে। একমাত্র ডাক্তার মেয়ে আর ডাক্তার জামাইয়েরও আসার ইচ্ছে ছিল। তবে সরকারি পেটোয়া বাহিনীর হামলায় আহত ছাত্র জনতাকে হাসপাতালে চিকিৎসা দিতে ব্যস্ত সময় যাচ্ছে ওদের। ডাক্তারশ্রেণী সরাসরি আন্দোলনের মাঠে কম থাকলেও তারা তাদের মত করে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। যদিও আহত আন্দোলনকারীরা যেসব হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে পুলিশ আর আম-জনতা গোষ্ঠির নেতা পাতিনেতারা সেসব হাসপাতালে গিয়ে ডাক্তারদেরকে চিকিৎসা দিতে বাঁধা দিচ্ছে, হাসপাতাল ভাংচুরের হুমকি দিচ্ছে। যে কজনের খবর ছড়িয়ে যাচ্ছে তাদের আহত বা নিহত হবার মেডিকেল রিপোর্টে বুলেটের কথা না উল্লেখ করতে চাপ প্রয়োগ করছে। ডাক্তাররা ওকেকজনের জন্য দুটো করে রিপোর্ট বানাচ্ছে। একটা সত্যি রিপোর্ট, যেটা ভবিষ্যতের জন্য কাজে লাগবে। আরেকটা হলো পুলিশের ভয়ে বানানো রিপোর্ট। রহমান চাচা তার ফার্মেসীর সব ওরস্যালাইন, মাথাব্যাথা, হাইপ্রেসার, লো প্রেসারের ওষুধ নিয়ে এসেছে। স্লোগানে স্লোগানে ক্লান্ত সূর্যসেনদের জন্য এই ওষুধগুলো দরকারি। আরো অনেককিছু আনার ইচ্ছে ছিল রহমান চাচার। তবে তার সাধ আছে সাধ্য নেই। রহমান চাচা নিজের শেষ সম্বল একটা জমি বিক্রির টাকা দিয়ে মেয়েকে ডাক্তারি পড়িয়েছেন। তবে জমির টাকা পুরোটা শোধ না করে সেই জমি দখল করে নিয়েছে স্বৈরসরকারের স্থানীয় ছিচকে নেতারা। রহমান চাচা সেই জমি কিংবা বাকি টাকা কোনোটাই উদ্ধার করতে পারে নি। কষ্টের টাকায় গড়া সম্পদ বেদখলে। রহমান চাচার যেন দেয়ালে টিঠ ঠেকে গেছে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া নির্যাতিত মানুষদের বাকি সব পরিচয় চাপা পড়ে যায়। তখন তাদের একমাত্র পরিচয় তারা শোষিত, নির্যাতিত। এই এক পরিচয়েই তারা হয়ে যায় এক বিশাল পরিবারের সদস্য।
সময়ের জনপ্রিয় লেখিকা তার একমাত্র মেয়ে সাইরাকে নিয়ে এসেছে এই আন্দোলনে। লেখিকাকে কেউ চেনে না। কোথাও তিনি নিজের ছবি ব্যবহার করেন না। তার লেখা তুমুল পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। তবে ব্যক্তি লেখিকাকে কেউ চেনে না, জানে না। সাইরার মধ্যে এই আন্দোলনের ইতিবাচক প্রভাব পড়ুন, এমনটাই চান লেখিকা। বড় হয়ে সাইরা যেন মাথা উঁচিয়ে বলতে পারে চব্বিশের এই আন্দোলনে সেও ছিল। মাথায় পতাকা বেঁধে সেও স্লোগান দিয়েছিল মায়ের সাথে। লেখিকা প্রথম যে গল্পের জন্য জনপ্রিয় হয়েছিল সেটা হলো 'মিউ'। একটা বিড়ালের গল্প। পোষা পশুপাখিদের আয়নাঘরখ্যাত কাঁটাবন থেকে তাকে একজন কিনে নিয়ে যায়। তবে যে লোকটা কিনে নিয়ে যায়, তার ছেলে বিড়ালটাকে পছন্দ করতো না। বিড়ালটা মিউ মিউ ডাকলেই ছেলেটা তাকে মারতো, ব্যাথা দিতো। ছেলেকে কেউ বোঝালে সে বলতো তার বাবা এই বিড়াল কিনে এনেছে, সে যা ইচ্ছে তাই করতে পারবে বিড়ালের সাথে। তাকে কেউ বোঝাতে পারতো না- বিড়ালকে কিনে আনলেই তার সাথে যা ইচ্ছে তাই করা যাবে না। ভয় দেখিয়ে বিড়ালের মুখের কথা আটকে রাখা যাবে না। সে কিছুতেই বুঝতো না। একদিন বিড়াল নিজেকে আর সংযত করতে না পেরে ছেলেটার ঘাড়ে কামড় দিয়ে বসে। একটা না, দুইটা না, কাঁধে চারটা দাঁত বসিয়ে দেয়। ছেলেটার কাঁধে রক্তের স্রোত বইতে থাকে। শোষিত প্রাণীর পিঠ দেয়ালে ঠেকলে তার মত ভয়ংকর আর কেউ হতে পারবে না। বর্তমান আন্দোলনের সাথে লেখিকার মিউ গল্পের মিল আছে। নিজের বাপকে নিয়ে যে ই অহংকার করেছে তারই অধঃপতন হয়েছে। সেটা লেখিকার মিউ গল্পের ছেলেটা হোক বা পুলিশ অফিসারের মেয়ে কিংবা রাজস্ব অফিসারের ছেলে হোক না কেন। বাকি শুধু একজনই আছে। কথায় কথায় নিজের বাপকে টানতে টানতে বেচারাকে নিজেই মাটিতে নামিয়েছে।
ছাত্রজনতা মুখে হাসি, বুকে বল, তেজে ভরা মন নিয়ে শাহবাগ দখলে নিতে প্রস্তুত।
আগে থেকেই মানুষের মনে আগুন জ্বলছিল। রাতের অধারে ভোট দুর্নীতি করে অবৈধ দুর্নীতিগ্রস্থ সরকার, পন্যের বাড়তি দাম,ক্রমবর্ধমান কতৃত্ববাদী শাসন, হাসিনা সরকারের আশির্বাদপুষ্ট আমলা ও সরকার দলের রাজনীতিকদের সীমাহীন অপরাধ, কেলেঙ্কারিতে জনগন দীর্ঘদিন ধরে অতীষ্ঠ হলেও মুখ বুঝে সহ্য করে আসলেও এই আন্দোলের মাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশের সুযোগ পায় মানুষ। তাই দেশের আনাচে কানাচে অল্প সময়েরই পৌঁছে যায় আন্দোলনের দাবানল।!
পুলিশও বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট, হেলমেট, লাঠি, বন্ধুক, লেগ গার্ড, হ্যান্ড গার্ড, ঢাল নিয়ে প্রস্তুত। আর বন্দুকের গুলির সামনে এই বাঘের বাচ্চাগুলো স্লোগান দিচ্ছে 'কে এসেছে কে এসেছে, পুলিশ এসেছে পুলিশ এসেছে। কি করছে করছে, স্বৈরাচারের পা চাটছে।' এক দুই তিন চার, নিপাত যাক স্বৈরাচার। আমার মাটি আমার মা, দেশটা কারো বাপের না। ছি ছি হালিমা, লজ্জায় বাঁচি না।’
দুপুর গড়িয়ে বিকাল হচ্ছে। সূর্য তার তেজ কমিয়ে পশ্চিম আকাশের দিকে হেলে পড়তে শুরু করেছে। শাহবাগে সাধরণ মানুষের এই জমায়েত জনসমুদ্রে রূপ নিতে বেশিক্ষণ সময় নিলো না। আজিমপুর মোড়ের একটা কম্পিউটারের দোকানের কর্মচারী বিল্লালও এসেছে। এই আন্দোলনে জয় পরাজয়ে তার কিচ্ছু যায় আসে না। তবে ছাত্রজনতার সাথে হওয়া অন্যায়ে কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের বসে থাকা সম্ভব না। বিল্লালের সাথে এসেছে মুস্তাফিজ। বিল্লালের এক সময়ের রুমমেট। একাডেমিক রেজাল্ট ভালো হয়েও কোটা বৈষম্যের জন্য ভালো চাকরি জোটাতে পারেনি সে। এখন ওর চাকরির বয়স শেষ। তবুও সে এসেছে। এই বৈষম্য দূর হোক, যেন তার মত আর কেউ ভুক্তভোগী না হয়।
স্লোগানে স্লোগানে মুখোরিত হচ্ছে শাহবাগ। মানুষের পদচারনায় শুকনো ধুলো উড়তে শুরু করেছে। হকার পানি বিক্রি করছে। একজন কিনছে তো দশজন খাচ্ছে। মধ্যবয়সী কয়েকজন গৃহিণী বাড়ি থেকে খাবার রান্না করে এনে আন্দোলনকারী কলেজ পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের গালে তুলে খাইয়ে দিচ্ছে। কেউ নিতে না চাইলে মায়ের শাসনে জোর করে মুখে গুজে দিচ্ছে আর বলছে- খালি পেটে স্লোগান দিলে স্বৈরাচারের কান পর্যন্ত আওয়াজ পৌঁছাবে না। এক লুকমা খেয়ে আরো জোরে স্লোগান দে বাবা। এক সাংবাদিক উনার পরিচয় জিজ্ঞেস করাতে উনি উত্তর দিলেন উনারা সবাই জাহানারা ইমাম। আর আন্দোলনের সব ছেলেমেয়ে হলো বাংলাদেশ। এটাই তাদের পরিচয়। এই কোটা সংস্কার উনার কোনো কাজে আসবে না। তবে এই ছেলেমেয়ের যৌক্তিক আন্দোলন দমাতে সরকার যেভাবে ছাত্রদের উপর গুলি ছুড়ছে, হামলা, মামলা দিয়ে, এসব অন্যায়ের প্রতিবাদ না করে ঘরে বসে থাকতে পারেননি। তাই সবাই নেমেছেন রাজপথে। এই ছেলেদের বোঝাতে চায়, তোমরা একা না, এই রাজপথে তোমাদের মায়েরাও আছে। পরিচিত না হয়েও সবাই যেন একই পরিবারের। লিঙ্গের তফাতের উর্ধ্বে সবাই যেন সূর্যসেন, তীতুমীর, নূরহোসেন। সবাই যেন বাংলাদেশ।
চিকচিক করা রোদ এসে পড়ছে পুলিশের হেলমেটের কাঁচে, বিক্ষোভকারীদের কারো কারো চশমাতে। এই শাহবাগ আজকে ছাত্র জনতা দখল করবেই। করতেই হবে। আজ হেরে গেলে বাংলাদেশ হারবে। যৌক্তিক অযৌক্তিক বহু আন্দোলন বিক্ষোভের সাক্ষী এই শাহবাগ। যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির দাবিতে আন্দোলন, আঠারো সালের কোটা আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনের মত বহু বড় বড় আন্দোলনের শুরুটা হয়েছে এখানে। ভৌগলিক ভাবে শাহবাগ গুরুত্ববহ হওয়াতে শাহবাগ দখল হলে সরকারও চাপে থাকে। তাই স্বৈরাচার সরকার শাহবাগের নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া করতে চাইবে না, সেটা ক্ষমতার অপব্যবহার করে সর্বচ্চো বল প্রয়োগ করে হলেও। ছাত্রজনতা নিজ উদ্যোগে স্লোগানে স্লোগানে উজ্জীবিত করে রাখছে সবাইকে। কেউবা গাইছে নজরুলের বিদ্রোহী গান, কেউ মাইক হাতে আবৃত্তি করছে কবিতা। পুলিশ আর স্বৈরসরকারের আম-জনতা গোষ্ঠীর সমর্থকদের হামলায় আহত অনেকে ব্যান্ডেজ নিয়েই চলে এসেছে বিক্ষোভে। কেউ লুঙ্গী পরেছে তো কেউ প্যান্ট, কেউ পাঞ্জাবি তো কেউ শার্ট, টিশার্ট। পোশাকের পার্থক্য থাকলেও চেতনার প্রশ্নে সবাই এক।
ক্যামেরার লেন্সে প্রতিবাদগুলো ধরে রাখার চেষ্টা করছে নাহিদ। সাংবাদিক নাহিদ পারভেজ, আন্দোলনের সংবাদ সংগ্রহ করতে অনডিউটিতে আছে। কোঁকড়া চুল, মাথায় ক্যাপ, হায়ে সাংবাদিকের ভেস্ট। বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় এক লেখিকাকে নিয়ে আর্টিকেল লিখে বেশ নাম কামিয়েছিল কয়েক বছর আগে। জেলা প্রতিনিধি থেকে ঢাকাতে এসে প্রথম কিছুদিন বিনোদন বিটে কাজ করতো। এখন সিটি রিপোর্টার হিসেবে কাজ করছে। পত্রিকার পক্ষে পুরো আন্দোলনকে পর্যবেক্ষণ করছে নাহিদ পারভেজ। খোঁজার চেষ্টা করছে আন্দোলনের গতিবিধি, আন্দোলনের পেছনের না জানা গল্প। আন্দোলনে সরকার আর সরকার দলের কার্যক্রমও জানবে নাহিদ। সাংবাদিকতার নিঁখুত চোখে ভর করে ক্যামেরার লেন্সে আন্দোলনের গল্প খোঁজার চেষ্টা করছে নাহিদ।
রৌদ্রোর তাপ কমেছে। ক্যামেরার কৃত্রিম আলো একটু বাড়িয়ে নিলো নাহিদ। নাহিদের ক্যামেরার লেন্স হঠাৎ খুঁজে পেলো এক পরিচিত মুখ। আরে এ তো কৌশিক। বছর পাঁচেক আগে নরসিংদিতে দেখা হয়েছিল সেই লেখিকার আর্টিকেল ইনভেস্টিকেশনের সময়। কি যেন নাম, ওহ, শাওনের ফ্রেন্ড কৌশিক। মাথায় বাংলাদেশের পতাকা বেঁধে মুষ্টিবদ্ধ হাত আকাশ পানে ছুঁড়ে স্লোগান দিচ্ছে কৌশিক। কৌশিকের কয়েকটা ছবি তুলে কাছে গেলো নাহিদ পারভেজ।
: আরে কৌশিক ভাই, কেমন আছেন?
: আপনি?
: চিনতে পারেন নি? আমি নাহিদ পারভেজ। কয়েকবছর আগে আপনার ব্যাংকের নিচে গিয়েছিলাম আপনার বন্ধু শাওন সম্পর্কে জানতে। কি, ঠিক বলছি তো?
: ওহ, চিনতে পেরেছি সাংবাদিক ভাই।
: আপনি এখানে? ঢাকাতে পোস্টিং নাকি এখন?
: না ভাই, নাসির নগরেই আছি। আজকে অফিস বন্ধ। তাই এসেছি। বিন্দু বিন্দু জল থেকেই তো মহাসমুদ্র হবে। আমরা না আসলে কিভাবে হবে?
: আপনাকে দেখে কি যে ভালো লাগছে ভাই।
: আপনারা সাংবাদিক মানুষ। আপনারা চাইলে অনেক ঘটনার মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারেন। প্লিজ ভাই, ছাত্রদের জন্য কিছু করেন।
: প্রায় সব মিডিয়া হাউজগুলোকে সরকার নজরদারিতে রেখেছে। চাইলেই সব করতে পারছি না। কোনো চ্যানেল সরকারের খারাপ দিক তুলে ধরলে সেটা ই বন্ধ করে দিচ্ছে। পাশার দান উল্টে গেলে সব দেখাবো ভাই।
: সাবধানে থাকবেন ভাই। আপনারা তো দুইপক্ষ্যের মাঝখানে পড়ে যান বারবার।
আপনিও সাবধানে থাকবেন ভাই। - বিদায় নিয়ে আবারো কাজে ফিরলো নাহিদ পারভেজ।
কাওরান বাজারের দিক থেকে কয়েকটা প্রিজন ভ্যান, বড় গাড়ি, জলকামান, সাজোয়াযান এসে জাদুঘরের সামনে এসে থামলো। আর এই খবর ছড়িয়ে পড়তেই মুহূর্তেই সেখানে চাপা উত্তেজনা প্রকাশ্য অগ্নিঝরা স্লোগান হয়ে ফিরে এলো।
আন্দোলনে আগে থেকেই ছেলের উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ থাকলেও আন্দোলনকে গতিশীল করতে মেয়েদের আরো বেশি উপস্থিতি দরকার ছিল। মেয়েদের উপস্থিতি আশানুরূপ না হলে আন্দোলনে মেয়ের উপস্থিতি বাড়ানোর জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সুধা প্রথম উদ্যোগ নেয়। হলের মেয়েদের গ্রুপে এই আন্দোলন নিয়ে প্রথম পোস্ট করে সে। প্রথম দিন মাত্র কয়েকজন মেয়ে ওদের সাথে যোগ দেয়। এভাবে প্রতিনিয়ত গ্রুপে এই আন্দোলনের প্রয়োজনীতা বোঝাতে থাকলে ধীরে ধীরে মেয়েদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। তবে সেটাও আশানুরূপ হচ্ছিল না। সুুধা কথা বলে ইডেন কলেজে তার বান্ধবী নন্দিনীর সাথে। নন্দিনীও ইডেনের হলগুলোতে মেয়েদের সাথে কথা বলে মেয়েদেরকে আন্দোলনে মাঠে নামার জন্য বোঝাতে থাকে। গতকাল রাতে সুধা আর নন্দিনী ওদের হলের সব মেয়েদের সাথে কথা বলে আজকে শাহবাগ দখল সম্পর্কে তাদের বোঝালে মেয়েরা এবার আর তাদের নিরাশ করেনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইডেন কলেজের ছাত্রী শিক্ষার্থীদের এই উপস্খিতি তার ই প্রমাণ। সবার মাথায় পতাকা বাঁধা, হাতে প্লেকার্ড। আর ঢাল হয়ে সহযোদ্ধা বোনদের আসলে রেখেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা কলেজের ভায়েরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীদের একটা বিশাল কমিউনিটিকে নেতৃত্ব দিয়ে আজকের গণ আন্দোলনে যোগ দিয়েছে রুমান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইয়াসিন, মনিরুল, জুয়েল, আদর আফসানা, সুধা, ঢাকা কলেজের নীল, বিপ্লব, তুহিন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সুফিয়ান, তাহিয়া, বাংলা কলেজের ফাহাদ, বুশরা, ইডেন থেকে নন্দিনী, প্রায়ভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তানভীর, জাফরীন, নেতৃত্ব দিচ্ছে। আর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি হয়ে কাজ করছে নিপা। আদরের সাথে আদরের বন্ধু বাসন্তি এসেছে। আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধি সাংবাদিক অর্ণ সরাসরি প্রকাশ্যে ওদের সাথে না থাকলেও ওর সাংবাদিকতার ট্যাগ কাজে লাগিয়ে ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ্যে কাজ করছে। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজগুলোর প্রতিনিধিদের সাথে রয়েছে তাদের নিয়মিত যোগাযোগ। নেতৃত্বে থাকা সহযোদ্ধারা সবাই সবার সাথে পরিচিত হয়েছে আন্দোলনের প্রথম দিকেই। এরপর আন্দোলন বহুদূর বহুভাবে গড়িয়েছে।
বাংলাদেশ খবরের সাংবাদিক প্রমা এসেছে চলমান আন্দোলনের সংবাদ সংগ্রহে, সাথে তার স্বামী কম্পিউটার ইন্জিনিয়ার রেদুয়ান নাবিল। স্ত্রীর নিরাপত্তা, আন্দোলনে নিজের সংহতি প্রকাশ আর অভিজ্ঞতার জন্য এসেছে নাবিল।
প্রতিনিধিরা নিজেদের মধ্যে কথা বলে ঠিক করলো তারা কে কি করবে? পরিকল্পনা মত তাদের সুফিয়ান, তানভীর, তাহিয়া, নন্দিনী গেলো গোলাপফুল আনতে। পুলিশের উর্ধ্বতনরা ঠিক কোন দিকে আছে সেটা খোঁজ নিয়ে গেলো জুয়েল, আফসানা, সুধা, নীল আর বিপ্লব। আর ততক্ষণে ইয়াসিন, মনিরুল, আদর তুহিন, ফাহাদ, বুশরা, জাফরীন, বাসন্তি বিভিন্ন ভাগে স্লোগান দিচ্ছে। ফুল আর পুলিশের খবর নিয়ে ফিরে আসলে ওরা ওদের পরবর্তী প্লান ঠিক করে নিলো। সবার ঘড়ির সময়টা মিলিয়ে নিলো যেন সবার ঘড়িতে একই সময় থাকে।
এবার ওরা কয়েকটা দলে ভাগ হয়ে গেলো। ঠিক ৪ টার পরপরই মনিরুল, জুয়েল, আদর আফসানা, সুধা, ফাহাদ, বুশরা যাবে পুলিশের উর্ধ্বতনদের গোলাপফুল দিতে। ফুল দেবার সময় সাংবাদিকদের সাথে নিয়ে যাবে। সাংবাদিক জমায়েতের দায়িত্ব অর্ণর। পুলিশকে সাংবাদিকদের ক্যামেরার সামনে ফুল দিয়ে তাদেরকে ব্যস্ত রাখবে। অর্ণ সহ আরো বেশকিছু সাংবাদিক পুলিশ অফিসারদেরকে আন্দোলন ও তাদের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন করবে। পুলিশের এই সাক্ষাতকার বিকাল চারটায় সব চ্যানেলের সংবাদে সরাসরি সম্প্রচার করা হবে ৪টা ১০ এ। এই লাইভ দুই মিনিট দেখাবে। ইয়াসিন, নীল, বিপ্লব, তুহিন, সুফিয়ান, তানভীর, তাহিয়া, নন্দিনী, জাফরীন, বাসন্তি আন্দোলনকারীদের সাথে মিশে গিয়ে নেতৃত্ব দিয়ে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে শাহবাগের দিকে দৌঁড় দেবে। পুরো ঘটনা ঘটাতে ওরা ২ মিনিট সময় পাবে। পুলিশের উর্ধ্বতনরা সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দিতে ব্যস্ত থাকায় আর সামনে এতগুলো মিডিয়ার ক্যামেরা থাকাতে সরাসরি বল প্রয়োগের কোনো অর্ডার দিতে পারবে না। আর সাধারন পুলিশ সদস্যরা তো হুকুমের গোলাম। হুকুম না পেলে একপাও এগোবে না। সংবাদ লাইভের সেই দুই মিনিটের মধ্যে এই শাহবাগ দখল করতে পারলে সারাদেশের আন্দোলনরত ছাত্রজনতা আরো দ্বিগুণ শক্তিতে উজ্জীবিত হবে। সারা দেশের ছাত্রজনতার চোখ থাকে ঢাকাতে, শাহবাগের দিকে। শাহবাগ দখল মানেই ছাত্রজনতার চূড়ন্ত বিজয় না। শাহবাগ দখল মানে স্বৈরসরকারকে বুঝিয়ে দেওয়া যে দেশের সাধারণ মানুষগুলো এক হয়েছে। এত এত বন্দুক, সাজোয়াযান, পুলিশ বাহিনী দিয়ে তাদেরকে দমানো সম্ভব হয় নি। এই জনতাকে আরো বেশি ক্ষাপালে শাহবাগ থেকে গণভবন দখলে নিতে দুইবার ভাববে না।
সারা দেশের চোখ তখন শাহবাগের দিকে। টেলিভিশের সামনে বসা দর্শকদের মধ্যেও টানটান উত্তেজনা কাজ করছে। সব চ্যানেল ফলাও করে প্রচার করছে ছাত্রজনতার এই যৌক্তিক আন্দোলন।
বাংলাদেশের প্রত্যন্ত একটা দ্বীপের সমুদ্রপাড়ের চায়ের দোকানদার জাকির চাচা ছিল সিনেমা দেখার পোকা। সেও যে কবে শেষ সিনেমা দেখেছে বলতে পারবে না। দেশের এই পরিস্থিতিতে তার এখন সময় কাটছে খবর দেখে। সব চ্যানেলে একই খবর। তবুও তার সব খবর বার বার দেখতেই হবে। খবরে দেখানো ছাত্রদের স্লোগানের সাথে সেও স্লোগান দেয়। ছাত্রজনতার শাহবাগে এই আন্দোলন হয়তো জাকির চাচা বুঝবে না। তবে ছাত্রজনতার বিজয়োল্লাসে জাকির চাচাও বেজায় খুশি। বিকাল চারটায় ছাত্র প্রতিনিধিরা ফুল নিয়ে পুলিশের সাথে কথা বলতে গেলো। সব টিভি চ্যানেল ততক্ষণে শাহবাগের অবস্থা সরাসরি সম্প্রচার করছে।
বহু বছর পর প্রিয় বন্ধু আদরকে টেলিভিশনের পর্দায় দেখলো রিমু। তাও আবার ঐতিহাসিক ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে। আদরের সাথে অনেক দিন যোগাযোগ নেই রিমুর। রিমু নিজে থেকেই হারিয়ে গেছে। আদরের সাথে রিমুর স্মৃতি যেন এখনো তরতাজা। দুজন দুজনের দিকে তাকালে মনের কথা বলে দিতে পারতো। আদরের সাথে মাঝে মাঝে মিসআন্ডারস্টান্ডিং হতো। তবে আদর বেশিক্ষণ কথা না বলে থাকতে পারতো না। রাগারাগির পর কেউ কথা বলতে চাইতো না। তবে কখনো আদর হার মানতো, কখনো রিমু। একবার কোনো একটা বিষয় নিয়ে আদর আর রিমুর মধ্যে চ্যালেঞ্জ হয়েছিল, তবে রিমু দোয়া করছিল যেন আদর জিতে যায়। কারণ প্রিয় বন্ধুর বিজয়োল্লাস দেখতে বেশ লাগবে রিমুর। অগোছালো অভিমানী সেই বন্ধুটা আজ কি সুন্দর গুছিয়ে কথা বলছে, একটা আন্দোলন সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। দূরত্ব হতে হতে এতটাই হয়েছে যে চাইলেও হুট করে সামনে এসে দাঁড়ানো যায় না, হঠাৎ পাশে এসে কাঁধ চাপড়ে চমকে দেওয়া যায় না। দূর থেকেই দেখতে হয়।
টিভির শোরুম থেকে শুরু করে চায়ের দোকান, অফিস থেকে বাসা সব টেলিভিশনের সামনে মানুষের ভিড়। পুলিশ কি তাহলে এ্যাকশন নেবে? ছাত্র জনতা ই বা কি করতে চাইছে? কখন কি ঘটবে বলা মুশকিল।
জুলাই আন্দোলন নিয়ে শাহরিয়ার সোহাগ এর উপন্যাস বাংলা বসন্ত। সংগ্রহ করুন রকমারি থেকে।
Comments
Post a Comment